বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ও নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের তিন বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে একটি রুটিন বৈঠক করেছেন।কিন্তু ২০ মে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকটি এমন এক সময়ে হয়েছে যখন ঢাকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে একটি ক্রমবর্ধমান ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলছে বলে একাধিক সরকারি কর্মকর্তা আল-জাজিরাকে জানিয়েছেন। বাংলাদেশে সামাজিক ও মূলধারার গণমাধ্যমে এই উত্তেজনাকে অন্তর্বর্তী প্রশাসন ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে ‘স্নায়ু যুদ্ধ’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতি এখন ইউনূসের ভূমিকার ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
২০২৪ সালের আগস্টে গণঅভুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা ভারত পালিয়ে যান। তাকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের ঘটনার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে।ইউনূস পদত্যাগের চিন্তা করছেন এমন গুজবের মধ্যেই ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তবে শনিবার উপদেষ্টা পরিষদের এক বৈঠকের পর পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ জানিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টা (ইউনূস) আমাদের সঙ্গেই আছেন। তিনি পদত্যাগের কথা বলেননি এবং অন্যান্য উপদেষ্টারাও আছেন। আমাদেরকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তা আমরা পালন করছি। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এই অচলাবস্থা এখনো কাটেনি।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ২০২৪ সালের জুলাই থেকে মোতায়েন রয়েছে। ওই সময় দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বেসামরিক বাহিনী কার্যত ভেঙে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর মোতায়েন জরুরি হয়ে ওঠে এবং তা এখনো বহাল রয়েছে। কারণ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখনো অস্থির।যদিও পুলিশ ২০২৪ সালের আগস্টের মাঝামাঝি আবার দায়িত্বে ফিরে আসে, দেশজুড়ে চলমান অস্থিরতার কারণে সেনাবাহিনীর মোতায়েন এখনো বহাল রয়েছে। একটিকে মূলত বেসামরিক-সামরিক সমঝোতার অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।গত বুধবার বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান প্রকাশ্যে আহ্বান জানান যে, জাতীয় নির্বাচন ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত।তিনি সতর্ক করে বলেন, দীর্ঘমেয়াদি বেসামরিক দায়িত্ব পালনে সেনাবাহিনী নিয়োজিত থাকলে দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।
দ্য ডেইলি স্টার-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার ক্যান্টনমেন্টে এক উচ্চপর্যায়ের সমাবেশে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, বাংলাদেশের প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। এটি শুধু একটি নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমেই সম্ভব, অনির্বাচিত সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের মাধ্যমে সম্ভব নয়।সেনাপ্রধান ওয়াকারকে উদ্ধৃত করে ডেইলি স্টার বলেছে, ‘সেনাবাহিনী দেশের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য, পুলিশের ভূমিকা পালনের জন্য নয়। নির্বাচনের পর আমাদের অবশ্যই ব্যারাকে ফিরতে হবে।’
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও অন্তর্বর্তী সরকারের উত্তেজনা রয়েছে। গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন দিক থেকে ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে রয়েছে এটি। দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন চায়। এক্ষেত্রে তারা অনড়। অন্যদিকে এ বছরের শুরুতে ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং আরও কয়েকটি দল বলছে, যেকোনো নির্বাচনের আগে দেশজুড়ে ব্যাপক সংস্কার ও গত বছরের ছাত্র আন্দোলনে দমন-পীড়নের ঘটনায় জড়িত সাবেক আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
বিএনপি আরও কিছু দাবিতে একের পর এক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। সে সবের মধ্যে রয়েছে ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে কারচুপির মাধ্যমে পরাজিত করা তাদের (বিএনপি) প্রার্থীকে (ইশরাক হোসেন) আবার মেয়র পদে পুনর্বহাল করতে হবে।বৃহস্পতিবার বিএনপি একটি সংবাদ সম্মেলন করে দাবি জানায় যে, বছরের শেষের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। পাশাপাশি দুই ছাত্র উপদেষ্টা ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদত্যাগ চাওয়া হয়।
শনিবার একটি বৈঠকের পর ঘোষণা করা হয় যে, ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে পদত্যাগ করবেন না।তবে ক্রমবর্ধমান এ অস্থিরতার মধ্যে ইউনূস হয়তো পদত্যাগের প্রস্তুতি নিচ্ছেন এমন গুঞ্জন আরও জোরালো হয়ে ওঠে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে প্রকাশ পেতে শুরু করে, ইউনূস বৃহস্পতিবার বিকেলে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তিনি পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন এবং টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। এর আগে এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে চলে ব্যাপক আলোচনা।
সেই সন্ধ্যায়, নাহিদ ইসলাম—যিনি জুলাই বিপ্লবের একজন ছাত্র নেতা এবং বর্তমানে নতুন গঠিত ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টির (এনসিপি) প্রধান ইউনূসের সঙ্গে দেখা করেন এবং তাকে দায়িত্বে থাকার জন্য অনুরোধ করেন।বৈঠকের পর নাহিদ ইসলাম বিবিসি বাংলাকে নিশ্চিত করেন যে, ইউনুস পদত্যাগের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করছিলেন।গত শুক্রবার সন্ধ্যায় অন্তর্বর্তী প্রশাসনের সূত্রগুলো আল–জাজিরাকে জানায়, ইউনূস এখনো তার সিদ্ধান্ত বিবেচনা করছেন।
বাংলাস্কুপ/ডেস্ক/এনআইএন